মুসয়াব ইবন উমাইর

মুসয়াব ইবন উমাইর ছিলেন মক্কার এক সম্ভ্রান্তপরিবারের সন্তান। বিপুল প্রচুর্য আর বিলাসিতার মধ্য দিয়ে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল। তাঁর সৌন্দর্য, দামী পোশাক, শাম দেশীও সুবাস সামগ্রী ইত্যাদির জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল সমগ্র মক্কায়। যেখানেই যেতেন তাঁর সৌন্দর্য ও সুগন্ধি সবাইকে বিমোহিত করে রাখত।.তাঁর এই সুখ স্বাচ্ছন্দ্য শেষ হয়ে যায় তখনই যখন তাঁর মা জানতে পারে যে তাঁর ছেলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছে। প্রাথমিক ভাবে তাঁকে তাঁর প্রভাবশালী মা বাড়িতে বেঁধে রাখে, তাঁকে সকল সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে।কিন্তু তিনি পালিয়ে হিজরত করতে চলে যান আবিসিনিয়ায়।.আবিসিনিয়া থেকে যখন তিনি ফিরে এলেন মক্কার সাহাবীরা খুব আশ্চর্য হয়ে গেল, এই কি সেই মুসাব? শ্রদ্ধায় সাহাবীরা দৃষ্টি নিচু করে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। রাসূল (সাঃ) সব দেখে বললেন –

“আলহামদুলিল্লাহ! এখন এই দুনিয়া আর দুনিয়ার মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হবে। এই সেই যুবক যার মত জাঁকজমক পূর্ণ ভাবে মক্কার কোন সন্তান বড় হয় নি।কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালবাসা আর ত্যাগ তাকে বদলে দিয়েছে, বিমুখ করেছে দুনিয়ার স্বার্থ থেকে।”

তারপর তিনি রাসূল (সাঃ) এর আদেশে প্রথম মদিনায় যান এবং দাওয়াত এর কাজ শুরু করেন। তাঁকে পাঠানোর মুখ্য কারন ছিল তাঁর বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা, সৎ চরিত্র আর কুরআন এর চমৎকার তিলাওয়াত। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাঁর কুরআন এর তিলাওয়াত শুনে দাওয়াতের আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে বনী আবদুল আশ’ হাল গোত্রের সবাই ইসলাম গ্রহন করল।.উহুদ যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) মুসলিম বাহিনীর পতাকা তুলে দিলেন মুসয়াব ইবন উমাইরের হাতে। এ ছিল সমগ্র সাহাবী সমাজে অত্যন্ত বিরল সম্মান এবং গর্বের বিষয়।.যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের অবস্থা দর্শনে মনে হল মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করতে চলেছে। তখনই একদল মুসলিম রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর নির্দেশ ভুলে গিয়ে গনিমতের মাল লাভ করার জন্য স্থান ত্যাগ করল। মুশরিক বাহিনীর একটি দল এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাল্টা আক্রমন করে বসল, ফলশ্র“তিতে ভীষন আক্রমনের মুখে মুসলিম বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলো। মুশরিক বাহিনীর সদস্যরা একটি লক্ষ্যের উপরই দ্রুত অগ্রসর হতে লাগল আর তা হল রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) কে খুঁজে বের করা এবং হত্যা করা।.দূরদর্শী মুসআব তাদের এ ভয়ংকর দূরভিসন্ধির ব্যপারটি ধরে ফেললেন। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এর সমূহ বিপদে তিনি কি করবেন তা তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলেন। মুহূর্তেই তিনি তাঁর হাতে ধরা মুসলিম বাহিনীর পতাকাটি উঁচুতে তুলে ধরলেন এবং উচ্চস্বরে তাকবীর দিতে লাগলেন। তাঁর চীৎকারে মুসলিম ট্রুপের পতাকাবাহীর দিকে মুশরিকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল এবং তারা প্রথমে এ পতাকাকে ভূলন্ঠিত করে পরবর্তি লক্ষ্যে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিল। একজন মুশরিক সেনা তার কাছে পৌঁছে একে একে তাঁর দুটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তিনি এবার বাহু দুটির অবশিষ্টাংশ দিয়ে ইসলামের পতাকা আঁকড়ে ধরে রাখলেন। এবার একটি তীক্ষ্ম বর্শা এসে তাঁর দেহে বিদ্ধ হল এবং তাঁর দেহটাকে এফোঁর ওফোঁর করে ফেলল। এবার মুসলিম বাহিনীর পতাকা মাটিতে পড়ে গেল। শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন মুসয়াব ইবন উমাইর।.যুদ্ধ শেষ হল। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যুদ্ধময়দান ঘুরে ঘুরে শহীদ মুসলিমদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এবং তাদের জানাজার আয়োজন করছিলেন। এক সময় ঘুরতে ঘুরতে তিনি প্রিয় মুসআবের কাছে এলেন। তাঁর চোখ বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ছিল। মুসআবের দেহকে ঢেকে দেবার জন্য একখন্ড কাপড় চাওয়া হলেও একমাত্র তার পোশাকটি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না। যে জামাটি তাঁর ছিল সেটি দিয়ে তাঁর পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে পড়ছিল এবং মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে পড়ছিল। অবশেষে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন- ”জামাটি দিয়ে ওর মাথা ঢেকে দাও এবং পা ইখজির (এক প্রকার ঘাস) দিয়ে ঢেকে দাও।”.তাঁর মৃত দেহের সামনে এসে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) অশ্রু সজল চোখে সূরা আহযাবের ২৩ নম্বর আয়াত টি পাঠ করেন –

“মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক এমন ও আছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে।”

আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলের প্রতি একজন মানুষের আনুগত্য ও ভালবাসা কোন পর্যায় পৌঁছালে সে এক নিমিষে সব ভুলে, সকল সুযোগ ছেড়ে, মৃত্যু ভয়ে ভীত না হয়ে যোগ দিতে পারে তৎকালীন অত্যাচারিত ইসলামের তাঁবুতে?